বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত ও গিটারের কিংবদন্তি তারকা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। যিনি তরুণ প্রজন্মের এলআরবি। দেশীয় ব্যান্ডসংগীতের তিনি মধ্যমণি। এলআরবি-র পথ চলার ২৭ বছরে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম হয় চট্টগ্রামে। তিনি ১৬ আগস্ট ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম রবিন। পরিবারের তেমন কেউ গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ঝোঁক। আধুনিক-লোকগীতি-ক্ল্যাসিক্যালের পাশাপাশি শুনতেন প্রচুর ওয়েস্টার্ন গান। নিজেও একসময় গাইতে চেষ্টা করেন। স্কুলে পড়াকালীন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আর তখন থেকেই ওয়েস্টার্ন মিউজিক ভালো লাগতে শুরু করে। শুরু করেন গিটার চর্চা। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর হয়ে ওঠেন তার অনুপ্রেরণার উৎস। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে একটা ব্যান্ডদল গঠন করেন। প্রথমে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘গোল্ডেন বয়েজ’, পরে নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। বিয়েবাড়ি, জন্মদিন আর ছোটখাট নানা অনুষ্ঠানে এই ব্যান্ডদল নিয়ে গান করতেন বাচ্চু।
স্কুল-কলেজের ছেলেমানুষি ভুলে বন্ধুরা যে যার মতো একেক দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক নিয়েই থাকলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ডে গান করতেন। ফিলিংসের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু জড়িত ছিলেন কিছুদিন। ১৯৮০ সালে যোগ দেন ‘সোলস’ ব্যান্ডে। সোলসের লিডগিটার বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন টানা ১০ বছর। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল গড়ে তুললেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি।
মজার ব্যাপার হলো, এলআরবি দিয়ে শুরুতে বোঝানো হয়েছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু কিছুদিন পর এক প্রবাসী বন্ধু জানান এই নামে অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যান্ড আছে। তাই প্রয়োজন হয় দলের নাম পাল্টাবার। এলআরবি আদ্যাক্ষর ঠিক রেখে ব্যান্ডের নতুন নাম রাখা হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। শুরুতেই এলআরবি চমক সৃষ্টি করে ডবলস ডেব্যু অ্যালবাম বের করার মধ্য দিয়ে। ‘এলআরবি- ১ ও ২’ নামের এই ডবলসের পর একে একে এ পর্যন্ত ব্যান্ডের আরো ১০টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সালে বের হয়েছিল সর্বশেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।
এলআরবিকে বেশি সরব দেখা গেছে দেশ-বিদেশের কনসার্টে। যে কোনো স্টেজ শোতে অংশ নেওয়ার আগে আইয়ুব বাচ্চু পুরো দল নিয়ে প্র্যাকটিস করতে কখনও ভুল করেন না। সারা দিন সময় না পেলে মধ্যরাতে হলেও তিনি প্র্যাকটিস করেন। ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশের কনসার্টে এলআরবি পারফর্ম করেছে। অংশ নিয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি কনসার্টে।
গানের পাশা পাশি গিটারেও তিনি ছিলেন অনন্য। ১৯৭৫ সালের কথা। সবে ক্লাস সেভেনে উঠেছেন। পরীক্ষার ফল খুব ভালো হওয়ায় বাবাও তার ওপর বেজায় খুশি। তিনি একটি কালো রঙের গিটার উপহার দিলেন। শুরু হলো লেখাপড়ার পাশাপাশি জীবনের নতুন একটি অধ্যায়। তারপর দীর্ঘ সময় এই গিটার ও গানের সঙ্গেই তার বসবাস।
তার কণ্ঠ দেয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। এটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি ‘সোলস’ ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশ হয়েছিলো ১৯৮৬ সালে। এই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি।
আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) দিয়ে। এরপর ১৯৯১ সালে বাচ্চু ‘এলআরবি’ ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো।
১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ ও ‘তবুও’ বের হয়। ‘সুখ’ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রূপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ পুরো দেশে আলোড়ন তৈরি করে। এর মধ্যে ‘চলো বদলে যাই’ গানটি বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। ১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অভিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ও ‘আমিও মানুষ’। একই বছর তার চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’ প্রকাশিত হয়। সেটিও সাফল্য পায়। আইয়ুব বাচ্চুর সর্বশেষ তথা ১০ম অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’ প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে।
আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া কিছু গান এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘এক আকাশের তারা তুই’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’ উল্লেখযোগ্য।
শুধু অডিও গানে নয়, প্লেব্যাকেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার গাওয়া প্রথম প্লেব্যাক ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গান। এছাড়া ‘আম্মাজান’ সিনেমার শিরোনাম গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
প্রখ্যাত এই শিল্পীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
You must be logged in to post a comment.