মারকিউলিস বললেই মনে পড়ে যায় গ্রিক দেবতা হারকিউলিসের কথা। একসময় বিটিভিতেও প্রচারিত হতো হারকিউলিসকে নিয়ে তৈরি টিভি সিরিজ। এ ছাড়া হলিউডে নানা ওয়েব সিরিজ ও সিনেমা তো হয়েছেই। মারকিউলিসেও আছে হারকিউলিসের কথা। মিথ অনুযায়ী, হারকিউলিস মানুষের উপকার করত। আর মারকিউলিস করে খুন!
এই ঈদে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি-তে মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘মারকিউলিস’। এর গল্প সম্পর্কে চরকি বলছে, ‘জয়িতার জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যখন তার বয়ফ্রেন্ড রবিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়। রবিনকে খুঁজতে এক অনিশ্চিত যাত্রায় বের হয় জয়িতা। ঘটনা জটিল রূপ নেয় যখন মারকিউলিস নামের এক খুনি ধর্ষকদের খুন করতে থাকে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অরাজকতা ও অবিশ্বাস দানা বাঁধে সমাজে।’
মারকিউলিস ওয়েব সিরিজের শুরুটাই হয় রবিন ও জয়িতার তুমুল ঝগড়া দিয়ে। সেই ঝগড়ার ফলাফলে হয় যোগাযোগ বন্ধ। আর তার পর চাইলেও আর রবিনকে খুঁজে পায় না জয়িতা। নিখোঁজ হয়ে যায় রবিন। এরপরই একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে নানা তথ্য। মাদকাসক্তির সঙ্গে সঙ্গে রবিন রেপিস্ট কিনা, সেই প্রশ্ন উঠে আসে। দিনে দিনে জটিল হতে থাকে জয়িতার জীবন। সেই সঙ্গে মঞ্চে আসে সন্তান হারানো মা, নারী নির্যাতনবিরোধী অধিকারকর্মী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ প্রমুখেরা। আর এদের সবার মধ্যমণি অচেনা, অজানা মারকিউলিস।
মারকিউলিস পরিচালনা করেছেন আবু শাহেদ ইমন। এর গল্পের লেখকও তিনি। এক কথায়, ওটিটির জন্য আদর্শ একটি গল্পই তিনি লিখেছেন। এতে মানুষের বাস্তব জীবনের জটিলতা, সমাজের বিচারহীনতার করুণ চিত্র, সিরিয়াল কিলারের রহস্যময়তা এবং সেসবকে পুঁজি করে চলা নিষ্ঠুর রাজনৈতিক খেলা– সবকিছুই ফুটে উঠেছে একে একে। এটি ঠিক যে, ওয়েব সিরিজের প্রথম সিজনেই এতগুলো বিষয় তুলে আনা এবং সেই অনুযায়ী গল্পের জাল বিস্তার করা ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়। তবে প্রথম সিজনে তা মুনশিয়ানার সঙ্গেই করেছেন পরিচালক-গল্পকার।
মারকিউলিস ওয়েব সিরিজে বেশ উচ্চকিত নানা চরিত্রের সমাহার ঘটেছে। অন্যতম প্রধান চরিত্র জয়িতাকে সিরিজের শুরু থেকেই উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখা যায়। কখনও কখনও যে তা কানেও লাগে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। তবে পুরো সিরিজের গল্পপ্রবাহ এবং তার সাথে জয়িতার জীবনের নানা ঘটনার তীব্রতার ওঠা-নামাকে বিচার করলে, সেটিকে মেনে নেওয়াই যায়।
এই সিরিজে আবহসংগীতের কাজ করেছেন ইমন চৌধুরী। শব্দ পরিকল্পনা ও মিক্সিংয়ের কাজ করেছেন রিপন নাথ। তাঁদের দুজনকে আলাদা করে ধন্যবাদ দিতেই হয়। পুরো সিরিজেই এই দুটি ক্ষেত্রে দুর্দান্ত কাজ করেছেন তাঁরা। কোথাও তাল-লয় কেটে যাওয়ার খুব একটা সুযোগই তাঁরা দেননি।
মারকিউলিস ওয়েব সিরিজের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক বিষয়টি হলো অনেক গুণী অভিনয়শিল্পীর সমাবেশ। চরিত্র অনুযায়ী শিল্পী নির্বাচনও যথাযথ ছিল। এবং এসব কারণে সঠিক চরিত্রে সঠিক অভিনয়শিল্পী অবদান রাখতে পেরেছেন ঠিকঠাক।
জয়িতা চরিত্রে সাবিলা নূর তাঁর প্রচলিত ইমেজ থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। ফলে সিরিজের মাঝামাঝি গিয়ে তাঁকে শুধু জয়িতাই মনে হয়েছে। রবিনের ভূমিকায় দারুণ ছিলেন শরীফ সিরাজ। তিনি ক্রমশই নিজের দক্ষতার পাল্লা ভারী করে চলেছেন। ইরেশ যাকের, গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও জাকিয়া বারী মম– যাঁর যাঁর ভূমিকায় ছিলেন বিশ্বাসযোগ্য। সন্তান হারানো মায়ের চরিত্রে সাবেরী আলম অনন্য। রাজনীতিবিদের চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু ও মামুনুর রশীদ অনবদ্য। তবে রওনক হাসানের চরিত্রটির আরেকটু বিস্তার ও বৈচিত্র্য থাকলে ভালো হতো। এমন চরিত্রে এই শক্তিশালী অভিনেতার আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে বলেই বোধ হয়।
বেশ সিরিয়াস ঘরানার গল্প নিয়েই এগিয়েছে মারকিউলিস। তবে এর মাঝেই কমিক রিলিফ দেওয়ার কিছুটা চেষ্টা হয়েছে। সেটি সব সময় যথাযথ মনে হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনেবুঝেই হয়তো বিদ্রূপাত্মক হয়েছে সংলাপ। কিন্তু গল্পের মূল প্রবাহের সঙ্গে একেবারে মিশে যায়নি তা। ফলে কিছুটা খাপছাড়া লাগতেই পারে।
মারকিউলিসের শেষের দুই পর্বে অনেক প্রশ্নের উত্তর যেমন মেলে, তেমনি নতুন প্রশ্নের সৃষ্টিও হয়। এই দুই বিপরীতধর্মী বিষয়টি অত্যন্ত কুশলীভাবে সম্পাদিত হয়েছে। সেই সাথে আছে সাসপেন্স ও মিস্ট্রির মোটামুটি নিখুঁত মিশেল। এ জন্য পরিচালক বাহবা পেতেই পারেন। শেষ পর্বের শেষ দৃশ্যে এক অচেনা কণ্ঠস্বর এক অর্থে দিয়েছে দ্বিতীয় সিজনের ঘোষণা। সেই কন্ঠটি বেশ চেনা। আশা করা যায়, ওই কন্ঠের অধিকারী অভিনেতাকে দ্বিতীয় সিজনে পর্দাতেই দেখা যাবে প্রবলভাবে।
মারকিউলিস এক কথায় এখনো পর্যন্ত এবারের ঈদের সেরা ওয়েব সিরিজ। এর প্রধান কারণ হলো, এক বসায় মারকিউলিসের ৮টি পর্ব দেখে ফেলা যায়। এবং শেষ পর্বের চমকে দ্বিতীয় সিজনে কী হবে না হবে, তা নিয়েও এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শুধু এই দুটি কারণেই দেখে ফেলতে পারেন মারকিউলিস। আপনার মূল্যবান সময় একেবারে নষ্ট হবে না কোনোভাবেই!
You must be logged in to post a comment.