অকল্পনীয় অভাবনীয় বললেও কম বলা হবে। একেবারে নিঃশব্দে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক বাড়ি। বাংলার সর্বকালের সেরা গায়িকার মৃত্যুর মাত্র ১৬ মাসের ভেতরে। অথচ এই বাড়ি সংরক্ষণ যোগ্য হওয়ার মতো ছিল। অনেক গায়ক ও সুরকার ওই বাড়িতে গিয়েছেন বারবার।
কেউই অনুমান করতে পারেননি এভাবে এত দ্রুত বাড়ির উপর প্রোমোটার চক্রের হস্তক্ষেপ হবে। সন্ধ্যার একমাত্র মেয়ে সৌমি কেন তার বিখ্যাত বাবা-মায়ের স্মৃতি এভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তা কেউ জানেন না।
সন্ধ্যা ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ। সেই বাড়ির কাছে থাকেন বিশিষ্ট নেতা অভিনেতা পরিচালক কেউই জানতেই পারেননি বাড়ি ভাঙা হবে।
ভাঙা বাড়ির মধ্যেই ধুলোয় পড়েছিলো সুন্দর অনেক জিনিসপত্র। সন্ধ্যার কাছে ঈশ্বরের সমতুল্য ছিলেন তার গুরু বড়ে গুলাম আলি খান। তারও একটি ছবি পড়েছিল ধ্বংসস্তূপের ময়লার মধ্যে।
সোমবার একটি ওয়েবসাইটে ভিডিও দেখানো শুরু হতেই গানের জগতে হইচই শুরু হয়ে যায়। কেউই জানতেন না বাড়ি বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা।
সন্ধ্যার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ এবং গায়ক সৈকত মিত্র তারাও সোমবারই জানতে পারেন ভিডিও দেখে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন তারা।
এখনো খন্ডহরের মধ্যে গেটের বাঁদিকে জ্বলজ্বল করছে তার বাড়ির ঠিকানা ডি/৬১৩, লেক গার্ডেন্স। ডান দিকে লেখা এস গুপ্ত। ভেঙে ফেলা ধ্বংসস্তূপ এর মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো সন্ধ্যার অনেক স্মৃতি। উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রার গায়িকার বাড়ির চত্বরে এখন শুধুই বিষাদের ছায়া।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রয়াত হওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর বাসভবন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এই বাড়ির মধ্যে দিয়ে শিল্পীর বর্ণময় কর্মকাণ্ডের ইতিহাস জানতে পারবেন সংগীতপ্রেমী নতুন প্রজন্ম। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না বরং হাতুড়ির আঘাতে চৌচির হয়ে গেল শিল্পীর বাসস্থান । শিল্পীর ভক্তদের দাবি যা হয়েছে তা শিল্পীর মেয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। এ নিয়ে তাই বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই কিন্তু এমনটি না হলে ভালো হতো।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১৯৩১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার ঢাকুরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে “জয়জয়ন্তী” এবং “নিশিপদ্ম” চলচ্চিত্রে গানের জন্য তিনি সেরা গায়িকা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তিনি ১৭টি হিন্দি সিনেমায় কণ্ঠ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় নিজ বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে বিয়ে করেন বাঙালি কবি শ্যামল গুপ্তকে।
বাংলা আধুনিক গান ছাড়াও বাংলা সিনেমায় সংগীত পরিবেশন করে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কণ্ঠস্বর হিসেবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্যও বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য কাজ করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
বাংলাদেশী সংগীত শিল্পী সমর দাস যিনি বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, তার সাহায্যে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেন সন্ধ্যা। কারাগারে বন্দি বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য “বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে”গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে ঢাকার পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন। এবং তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে অন্যতম প্রথম বিদেশি শিল্পী।
You must be logged in to post a comment.