নানা ঘটনার কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বিদায়ী বছর ২০২২। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডের কিছু ঘটনা আলোচিত ছিল বছর জুড়ে। একই সাথে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক নানা ইস্যুতে ২০২২ সাল গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর।
স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সবচেয়ে বড় প্রকল্প স্বপ্নের পদ্মা সেতু’র সফল উদ্বোধন হয় বিদায়ী বছরে। ২৫ জুন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের অপার সম্ভাবনার দ্বার। সব অপবাদ, ষড়যন্ত্র ও অনিশ্চয়তা জয় করে নিজেদের অর্থায়নেই বাস্তবায়ন হয় এই মেগা প্রজেক্ট।
অবকাঠামো খাতের আরেক বড় প্রকল্প মেট্রোরেল চালু করা হয় বছরের একেবারে শেষ দিকে। ২৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে নগর যোগাযোগে উন্নত শহরের কাতারে যুক্ত হল ঢাকা। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো এমন স্বপ্ন সত্যি হওয়ায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০২২ সাল।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কর্মসূচি এবং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বছর খানেক আগে ২৪ ডিসেম্বর দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দশমবারের মতো সভাপতি নির্বাচন হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আর তৃতীয়বার সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের। চমকহীন সম্মেলনে বাকি প্রায় পুরোটাই পুরোনোদের নিয়ে নতুন কমিটি।
বছরের শেষে এসে নতুন নেতৃত্ব পায় ছাত্রলীগ। কমিটির সভাপতি হন ডাকসুর সাবেক এজিএস সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানকে। বিদায়ী কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য্যের বিরুদ্ধে প্রেসরিলিজ মাধ্যমে কমিটি, চিঠির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দেয়ার মতো নানা অভিযোগ। ফলে সংগঠনে দেখা হয় বিভক্তি ও অসন্তোষ।
রাজনৈতিক অঙ্গনে বিদায়ী বছরের আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল-বিএনপির দেশব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচি। বিভাগীয় পর্যায়ের গণসমাবেশের শেষ কর্মসূচি নিয়ে উত্তপ্ত হয় দেশের রাজনীতি। ১০ ডিসেম্বরের সেই কর্মসূচির স্থান, নয়াপল্টন নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান? এ নিয়ে ব্যপক সংঘাত, হামলা, ভাংচুরসহ গ্রেফতার হন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ কয়েকশ’ নেতাকর্মী। শেষ পর্যন্ত গোলাপবাগ মাঠে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় গণসমাবেশ।
বছর জুড়েই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়াকে কয়েক মাস কাটাতে হয় হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎকসার জন্য বিদেশ পাঠানোর দাবি উঠলেও সরকারের অনুমতি মেলেনি।
কূটনৈতিক মহলের আলোচিত খবর ছিল র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। যা বিদায়ী বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত করে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে লবিস্ট নিয়োগের কথাও বলেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু বছর শেষ হয়ে এলেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি। তবে নতুন করে আর কোন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা নেই বলে ২০ ডিসেম্বর জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ঢাকায় মায়ের ডাকের সমন্বয়কের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়াকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক বিতর্ক গড়ায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বৈরিতা পর্যন্ত।
বিদায়ী বছরে দেশের বিদ্যুত খাত ও জ্বালানি খাতও ছিল বেশ আলোচিত। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি থমকে দেয় এই খাতের অগ্রগতি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে টালমাটাল হয় দেশের বাজারও। আমদানি কমানো, দাম বৃদ্ধি, রুটিন লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ের কৌশল নেয় সরকার। নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুত না পাওয়ায় অস্বস্তি ছিল শিল্পখাতে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতির বৈশ্বিক অস্থিরতার পারদ চড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দামে। নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে বাংলাদেশও বাধ্য হয় জ্বালানির দাম বাড়াতে। ডিজেল-কেরোসিন ও পেট্রোলের ৫০ শতাংশ দামের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি ছুঁয়ে যায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশের চূড়া। ভোগান্তি চরমে ওঠে স্বল্প আয়ের মানুষের। সেইসাথে, বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে রাতারাতি।
বাংলাদেশ নারী দলের সাফ জয় ছিলো ফুটবলে বিদায়ী বছরের সেরা সাফল্য। গ্রুপ পর্বে ভারত, পাকিস্তান ও মালদ্বীপকে হারায় বাংলাদেশ। আর ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার নারী ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তুলে বাংলাদেশ দল।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে ২০২২ স্মরনীয় হয়ে থাকবে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের কারণে। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সকে ট্রাইবেকারে চার-দুই গোলে হারিয়ে ৩৬ বছর পর শিরোপা যায় আর্জেন্টিনার ঘরে। যার ঢেউ আছড়ে পরে দেশের মাটিতেও।
বিদায়ী বছরের শেষ দিকে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের শোকের ছায়া নেমে আসে কালোমানিক খ্যাত ফুটবলার পেলের মৃত্যুতে। ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি ফুটবলার বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিনগত রাত একটায় সাও পাওলোর এক হাসপাতালে ৮২ বছর বয়সে মারা যান।
বিদায়ী বছরের শুরুতে ২০ ফেব্রুয়ারি অনেকটা আকস্মিকভাবে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক আক্রমণ করে রাশিয়া। গোটা বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সময়ের সাথে সাথে পুরো ইউক্রেনজুড়ে চলে রুশ আগ্রাসন।
পশ্চিমাবিশ্বের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হামলা অব্যহত রেখেছে রাশিয়া, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বেই। তীব্র খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ধস নেমেছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে। ফলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও একটি সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মুখে গোটা ইউরোপ।
অপরাধ জগতে বিদায়ী বছরে আলোচার জন্ম দেয়, ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের কাছ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা। নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মুখে বরখাস্ত করা হয় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে। দুই জঙ্গিকে ধরতে দেশজুড়ে রেড এলার্ট পাশাপাশি ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গির নাগাল এখনো পায়নি আইন-শৃংখলা বাহিনী।
২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে রাসায়নিক বিস্ফোরণ দেখে কেঁপে উঠে গোটা এলাকা। বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বিস্ফোরণের সেই ঘটনায় মৃত্যু হয় ৪৯ জনের। এর মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীও মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ আহত হয় দুই শতাধিক। কয়েকদিনের চেষ্টায় ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এর মালিকানা নিয়ে ছিলো ধোয়াঁশা। এতোগুলো প্রাণ ঝড়ে গেলেও, কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দৃশ্য চোখে পড়েনি।
সফলতা-ব্যর্থতা, আনন্দ কিংবা বেদনার নানা ঘটনা সঙ্গী করে বিদায় নিচ্ছে ২০২২। আর প্রত্যাশা নতুন সম্ভাবনায়, সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে উঠুক আগামীর প্রতিটি সূর্য।
You must be logged in to post a comment.