প্রথম দৃশ্যেই কমিক্যাল রিলিফ দিয়ে শুরু। এরপরই চলে এল টান টান উত্তেজনার পুলিশ-অপরাধীর লুকোচুরি খেলা। সিরিজের প্রথম পর্বেই এমনটা পেলে জমে যায় দারুণ। বলছিলাম ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’-এর কথা। কিন্তু সময় ও পর্ব গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কি গল্পের সেই সটান বৈশিষ্ট্য ও সাযুজ্য টিকে থাকল? কেমন হলো দেশের প্রথম স্পিন অফ সিরিজ?
চাঁদরাতে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি-তে মুক্তি পেয়েছে সাত পর্বের ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। বলা হচ্ছে, এটি দেশের প্রথম স্পিন অফ সিরিজ। মূলত প্রচারিত হওয়া এক সিরিজের গল্প বা চরিত্রের সূত্র ধরে যদি গল্পের নতুন উপশাখা ছড়ানো হয় এবং তা দিয়ে তৈরি হয় নতুন ওয়েব সিরিজ, তবে সেটিকেই বলা হয় স্পিন অফ সিরিজ। চরকি-তে এর আগে মুক্তি পেয়েছিল অরিজিনাল সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’। তাতেই এক রহস্যময় চরিত্র ছিল অ্যালেন স্বপন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই চরিত্র বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। এবার সেই চরিত্রকে কেন্দ্র করেই আলাদাভাবে তৈরি হলো ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। দুই সিরিজেরই নির্মাতা গুণী পরিচালক শিহাব শাহীন।
‘সিন্ডিকেট’-এ যেভাবে অ্যালেন স্বপনকে দেখানো হয়েছে, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ আসলে তার আগের সময়ের গল্প। সীমান্তের চোরাকারবারি সিদ্দিক কীভাবে ঢাকায় এসে শামসুর রহমান হয়ে ওঠে, সেটিই জানা যাবে নতুন সিরিজে। চরকি এই সিরিজের গল্প সম্পর্কে জানিয়েছে, ‘২০১৮ সাল, কক্সবাজার। সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান চলছে জোরেশোরে। হঠাৎ চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে, কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী অ্যালেন স্বপন ক্রসফায়ারে মারা গেছে। একই সময় প্রায় একই রকম দেখতে একজন, শামসুর রহমান আবির্ভূত হয় ঢাকা শহরে। কে এই শামসুর রহমান?
অ্যালেন স্বপন আসলে একজন চূড়ান্ত স্বার্থপর অপরাধীর গল্প। শুধু নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনে সে পরিবারকেও ছাড়ে না। এই অ্যালেন স্বপনের ধীরে ধীরে শামসুর রহমান হয়ে ওঠা এবং শামসুরের মধ্যে আবার অ্যালেনকে ফিরিয়ে আনার ঘটনাচক্রই দর্শকেরা দেখতে পাবেন নতুন সিরিজে। প্রথম চারটি পর্বে তাই রূপান্তরের গল্পই ঘুরেফিরে আসে এবং এর প্রায় যৌক্তিক উপস্থাপনাও দেখা যায়। কিন্তু এরপরই ঘুড়ি হয়ে যায় ভোকাট্টা। চলে আসে চিত্রনাট্যে অসঙ্গতি ও সেই অনুযায়ী সংলাপের গণ্ডগোল। এটা আসলে ডিম আগে না মুরগি আগের মতো বিষয়। কোনটার কারণে কী ফলাফল– তা বলা মুশকিল। সেটা নির্মাতারাই ভালো বলতে পারবেন।
কিছু প্রশ্ন রাখা যাক বরং। ধরুন, কারও অবৈধ উপায়ে আয় করা ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা আছে। সেই টাকার গরমে ওই অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা প্রশাসনিক প্রভাব আসলে কতটা হবে? প্রভাব কি এতটাই কম হবে যে ঢাকার কোনো নির্দিষ্ট এলাকাকেন্দ্রিক অপেক্ষাকৃত ছোট সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে পুলিশের মাঝারি মানের অফিসার – সবার ভয়েই তিনি দৌড়ে দৌড়ে পালাবেন? বাস্তবতার এই অভাবটি সিন্ডিকেটেও ছিল, আছে অ্যালেন স্বপনের নিজের গল্পেও।
এবার আরেকটি প্রশ্ন। সেই অপরাধী যদি শত শত কোটি কালো টাকা সাদা করতে চায় এবং সেই টাকা মজুত করতে শুরু করে, তবে কি তার প্রক্রিয়া দেখতে চাইবেন না দর্শকেরা? অবশ্যই চাইবেন। কারণ, ক্রাইম থ্রিলার জঁরার ওয়েব সিরিজে ক্রাইমের ধরন দেখানোটাই স্বাভাবিক। আর যাই হোক, হাওয়া থেকে তো টাকা আসে না!
এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে। পুলিশ বা প্রশাসনের লোকেরা যাকে বলে চুনোপুঁটি বা সদ্য ডানা গজানো ছোট্ট ড্রাগ ডিলার, কেউ আবার চেনেও না বা নামও শোনেনি, তার কাছে কীভাবে থাকে টাকার পাহাড়? একটি চরিত্রকে রহস্যময় করে তুলতে গেলে তার চারপাশে কিছু মিথ তৈরি করতেই হয়। নইলে যে চরিত্রে আর রহস্যের কালো মেঘ থাকে না, হয়ে পড়ে খটখটে রোদের মতোই সাদামাটা। যেটি অ্যালেন স্বপনের বেলাতেও নিদারুণভাবে হয়েছে।
এই রে! এই বুঝি অ্যালেন স্বপন এখনই তিতিবিরক্ত হয়ে বলে উঠবে, ‘আপনি দেখি আমার বউয়ের মতো খালি প্রশ্ন করেন’! থাক, প্রশ্নবাণ না হয় ঝুলিতেই থাক। কিন্তু বলতেই হয়, একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় চরিত্র আরও বড় হয়ে ওঠার যাত্রায় হোঁচট খেয়েছে। অ্যালেনের কথাতেই বলতে হয়, ‘হতাশ, আমি খুবই হতাশ’!ছবি- চরকির সৌজন্যে
তবে পর্দায় অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। অ্যালেন স্বপন হিসেবে নাসির উদ্দিন খানের তুলনা হয় না। এই অভিনেতা একাই টেনে নিয়ে গেছেন পুরো সিরিজ। অ্যালেন স্বপনের চরিত্রে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয় দেখাটা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেননি। শায়লা চরিত্রে রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা নিখুঁত অভিনয় করেছেন। সুমন আনোয়ার যথারীতি ত্রুটিমুক্ত। তবে আলাদা করে বলতেই হয় অ্যালেনের ছেলে ‘যাদু’-রূপী আব্দুল্লাহ আল সেন্টুর কথা। চরিত্রের সঙ্গে একেবারে যেন মিশে গিয়েছিলেন সেন্টু। কখনো মনেই হয়নি সেন্টুর ভেতরে ‘যাদু’ নেই! চরিত্রের একেবারে স্বার্থক রূপায়ণ হয়তো একেই বলে!
সিরিজে ক্যামেরার কাজও ছিল নজরকাড়া। আবহসঙ্গীত দুরন্ত। আর একেবারে শেষে নাসির উদ্দিন খানের কণ্ঠে ‘তৈ তৈ তৈ/ আমার বৈয়ম পাখি কই?’ শীর্ষক গানটি দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা। গানটি সত্যিই বেশ উপভোগ্য।
কিন্তু সমস্যা হলো, অ্যালেন স্বপনের জীবনের গল্পের বৈয়ম পাখি যে সত্যিই নিখোঁজ। অ্যালেন যতই ‘পিউচার নিচ্চয়তার গ্যারান্টি’ দিন না কেন, তাতে আস্থার ঘাটতি বেশ খানিকটা রয়েই যাচ্ছে।
এক কথায় বললে, দেশের প্রথম স্পিন অফ সিরিজ পরীক্ষায় পাস করলেও এ প্লাস পায়নি। ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ ইজ গুড, বাট নট দ্য বেস্ট।
You must be logged in to post a comment.