‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ দেখা হলো চট্টগ্রামের সুগন্ধায়। এমন ছবি মুক্তির প্রথম সপ্তাহে সারাদেশে কেবল মাত্র একটি হল পাওয়া সত্যিই পীড়াদায়ক। অবশ্য মুক্তির আগে আরো গুরুত্বের সাথে প্রচারণা চালানো হলে বোধহয় ছবিটা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারতো। যাইহোক, আশাকরি শিগগির জেলা শহরগুলাতে পৌঁছে যাবে এই ছবি। যাওয়াই উচিত। নাহলে ছবিটার প্রতি চরম অবিচার হবে।
কেন বলছি? প্রথমত গল্পটা। এরকম স্ট্রং গল্পের সিনেমা বর্তমান সময়ে না কেবল, নিকট অতীতেও খুব কমই নির্মিত হয়েছে দেশে। যে গল্পের প্রধান চরিত্র ‘হাওর’ বিশদে বললে ‘প্রকৃতি’। সময়ের সাথে সাথে তার রূপ বদলায় আর এই রূপ বদলের খেলায় মানুষ কখনও দর্শক হয় আবার কখনও হয় নির্মম শিকার।
আলোচনায় আসতে ইচ্ছে হয়, আমার কাছে আসেন: জয়
ছবিতে হাওরের সাথে মানুষের তথা হাওরের মানুষের দ্বিতীয় সম্পর্কটাই মূর্ত হয়ে ওঠেছে। কিছু কিছু দৃশ্যতো পুরাপুরি ভিন্ন আমেজ নিয়ে ধরা পড়েছে, যেমন ধরেন মাইকে বিয়ের গান বাজিয়ে নৌকাযোগে বরযাত্রা, তা দেখে মানুষজনের পুলকিত হওয়া; ভাসমান ফেরিওলার নিত্যপণ্য ফেরি করে বেড়ানো আবার তারে ব্যবহার করা হচ্ছে সংবাদ বাহক হিসেবে- এইসব।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনও হাওরে ভ্রমণ করিনি কিন্তু পুরো ছবিতে আসলে ঘুরেফিরে হাওরই দেখেছি বলে মনে হলো। এমনকি যতোটা না আনন্দভ্রমণে গিয়ে দেখতাম তার চাইতেও বিশদে এই সিনেমায় দেখতে পেয়েছি। ‘ভাটির দেশের মাটির ছবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তাই আমার কোনো আপত্তি নাই।
ছবির প্রথমদিকে মনে হচ্ছিলো লাইট আর কালারের ব্যবহার আরেকটু ভাল হতে পারতো, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সেটা না হওয়াতেই ছবিটা বাস্তব হয়ে উঠছে। পারফেক্ট লোকেশনে পারফেক্ট দৃশ্য গ্রহণের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ছবিটা। পুরো ছবিতে শব্দের ব্যবহার, বিশেষ কইরা মিউজিকতো দারুণ লাগছে আমার কাছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর রাধারমনের গান দুটোর কী চমৎকার ব্যবহারই না করছেন পরিচালক! গল্পের সাথে সাথে হাওরে চাউর থাকা কিছু উপকথা, ফসলের মঙ্গলের জন্য তেলগাছি পূজা, ক্ষেত বান্ধার মতো ঘটনাগুলো অবাক করার মতোন। আর অভিনয়? না, অভিনয় বলে মনেই হয়নি।
বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন তামান্না ভাটিয়া
ফসল অর্থাৎ ধান যে কত আরাধ্য একটা ব্যাপার হতে পারে, কতটা পবিত্রজ্ঞানে পূজনীয় হতে পারে তা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। আরেকটা বিষয় যেটা লক্ষ্যণীয় ‘সমান হিস্যা’র মতো শব্দবন্ধ। যা পুঁজিবাদের এই চূড়ান্ত সময়ে রীতিমতো নিষিদ্ধ- এই কথাটা উচ্চারণ করে দুর্দশায় জর্জরিত হাওরের দরিদ্র পরিবারগুলোর মুক্তির পথ দেখাতে না পারার ঘাটতিকে কিছুটা হলেও পূরণ করে গেছেন পরিচালক মুহাম্মদ কাইউম।
একেবারে শেষ লাইনে এসে ছবিটা শেষ হয়েছে একটা বিদেশী প্রবাদ দিয়ে-‘ভাগ্যাহতরা হয়ত ক্ষেপে উঠে, নয়ত কেঁদে মরে’। এর পর আর কথা থাকে না। ছবিটা মূলত ভাগ্যাহতদেরই।
দুয়েকটা নেতিবাচক বিষয় যে চোখে পড়েনি, তা না। প্রথমত ভাতের অভাবে সবাই না খেয়ে আছে এরইমধ্যে বিয়ের মতো একটা আনন্দ আয়োজন! খানিকটা বেখাপ্পা। এরপর চরিত্রগুলোর ভাষা দু’এক জায়গায় সাবলীলতা হারিয়েছে বলে মনে হলো। আর সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হলো, যেন পরিচালক একটা দীর্ঘ হৃদয়গ্রাহী অথচ বাস্তব গল্প বলতে বলতে হঠাৎ একটু ঢিল মারলেন! আমি আসলে দ্বিতীয়বার ঢলের পানিতে ফসল ডুবে যাওয়ার পরবর্তী ঘটনাগুলো উপস্থাপনের কথা বলছি। ঘটনাটা যতটা প্যাথেটিক ঠিক ততোটা কেনো যেনো স্পর্শ করতে পারেনি। পেপার কাটিং এর ব্যবহার আর সাক্ষাৎকারধর্মী সংলাপের কারণে এই জায়গায় মনে হচ্ছিলো ছবির আবেদন থেকে কিছু বিচ্চুত হলাম যেনো! এই অংশে দুটো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে পরিচালকের দিক থেকে, হয় মনোযোগের ঘাটতি নয়ত অতিমনোযোগ!
যাইহোক, এই সমালোচনাগুলো সত্বেও ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ একটা চমৎকার, নান্দনিক এমনকি মাটি এবং মানুষের ছবি হয়ে উঠতে পারছে বলেই সাক্ষ্য দিচ্ছি। আন্তরিক সদিচ্ছা ছাড়া এমন শিল্পকর্ম সহজে হয়ে উঠে না। পরিচালকের এমন সদিচ্ছাকে সম্মান জানাই। সম্মান জানাই কলাকুশলীদের।
কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: মুহাম্মদ কাইউম
অভিনয়ে: জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সুমি ইসলাম, সামিয়া আকতার বৃষ্টি, বাদল শহীদ, মাহমুদ আলম,আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
চিত্রগ্রাহক: মাজহারুল রাজু
পরিচালকের বিশেষ সহকারি: প্রয়াত গাজী মাহতাব হাসান
You must be logged in to post a comment.